‘সমাজে বাড়ছে নীতি-নৈতিকতাহীন মানুষের সংখ্যা’

মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। সেটা তার বিবেকবোধ বা আচরণগত কারণের জন্যই। মানুষের যে গুণটি সবার আগে থাকা উচিত সেটি হচ্ছে মানবিকতা। মানুষকে মানুষ বলা হয় কারণ তার মধ্যে মানবিকতা আছে, বোধ-বিবেক আছে, হিতাহিত জ্ঞান আছে, ভালো-মন্দ যাচাই করার সক্ষমতা আছে যা অন্য কোনো প্রাণী বা জীবের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজ হয় উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে সমাজে নেমে আসে অধঃপতন। তখন মানুষের ভেতর ভর করে পশুত্ব। চারপাশে ঘটে যাওয়া এমন সব ঘটনা আমাদের অবলোকন করতে হয় যে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- মানুষের বিবেকবোধ কি বিলুপ্ত হয়ে গেল?

নীতিহীন সমাজ যে উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর, অনিশ্চিত ও অসহিষ্ণু হয়, তার ভুরিভুরি উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে বাড়ছে আত্মহত্যাসহ নানা অপরাধপ্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কেও সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। সমাজে প্রায় প্রতিটি সম্পর্কই নড়বড়ে হয়ে গেছে। ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধাবোধের বদলে সম্পর্কগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছে বৈষয়িক নানা বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ের শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, নকলপ্রবণতা, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ ইত্যাদি সমাজের করুণ রূপ। সমাজের মানুষ কেউ যেন কারো বন্ধু নয়। প্রত্যেকে পরোক্ষভাবে একে-অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন।

যে মানুষের ভিতরে মনুষ্যত্ব নেই সে মানুষ পশুর সমান। মানুষগৃহে জন্মগ্রহণ করলেই মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন হয় কঠোর সাধনার। জ্ঞান আহরণ, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ নিজের বুদ্ধি ও বিবেককে বৃদ্ধি ও বিকশিত করতে পারে। অন্য কোনো প্রাণী বা বৃক্ষলতা তা পারে না। জন্মের পর তাদের শুধু দৈহিক বৃদ্ধি হয়, কিন্তু মনের বিকাশ হয় না। কিন্তু তরুলতা ও পশুপাখির তুলনায় মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। জন্মের সময় মানুষ পশু প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্ম পরবর্তী সময়ে বিদ্যা–শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানবিক গুণসম্পন্ন হয়। এ মানবিক গুণই তাকে তরুলতা ও পশুপাখি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। তাছাড়া জীবন চলার পথে মানুষের অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজন মিটানোর জন্য মানুষকে একে একে অনেক কিছুই আবিষ্কার করতে হয়; যা তরুলতা কিংবা পশুপাখির বেলায় কল্পনাও করা যায় না। এ আবিষ্কারের জন্যও মানুষকে দীর্ঘ গবেষণা করতে হয়। প্রকৃতির নিয়মে জন্মলাভ করেই তরুলতা ও পশুপাখি তরুলতা ও পশুপাখি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্যে মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করা খুবই কঠিন। প্রাণপণ চেষ্টা ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়।

সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাতে হোমনা থেকে মুরাদনগরে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসা এক নারীকে পাঁচকিত্তা গ্রামের শহিদ মিয়ার ছেলে ফজর আলী কৌশলে ঘরের দরজা খুলে ধর্ষণ করেন। ঘটনার সময় আশপাশের কয়েকজন লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ভুক্তভোগী নারীকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে ভিডিও ধারণ করে এবং পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় প্রধান আসামিসহ গ্রেপ্তার করেন পুলিশ ৫ জনকে।

এমন আরো অনেক অপরাধই সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এমন সব সংবাদ আমরা গণমাধ্যমে দেখি, তাতে আমাদের শিউরে উঠতে হয়। এসব ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সমাজে ক্রমশ নীতি-নৈতিকতাহীন অমানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, আর আমরা হারিয়ে ফেলছি সামাজিক মূল্যবোধ।

সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়, মানুষের মধ্যে বেড়ে যায় নানা অপরাধপ্রবণতা। যা বর্তমান সমাজে প্রকট। সামাজিক নিরাপত্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এ থেকে মুক্তি পাব না? মানুষ কি মানুষের প্রতি সহনশীল হবে না? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন হলেও এর প্রতিকারের উপায় আমাদের বের করতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আশা করি, মানুষের বিবেক জাগ্রত হবে। সমাজে ফিরে আসবে নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, সাংবাদিক

Share on whatsapp
WhatsApp
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram