অভিযানের পরও ইটভাটায় জ্বলছে কাঠ!

মো. সাইফুল ইসলাম ভান্ডারী: ফটিকছড়িতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনা করছে একটি চক্র। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বনের কাঠ। ইট তৈরির মাটির জন্য কাঁটা হচ্ছে পাহাড় এবং টপ-সয়েল। ফলে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও আন্তরিকতায় বহাল তবিয়তে এসব অবৈধ ইটভাটা। অভিযোগ উঠেছে লোক দেখানো অভিযান করার ফলে বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ইটভাটা।

ইটভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দু’টি পৌরসভাসহ ১৯ টি ইউনিয়নে ৫৪ টি ইটভাটায় থাকলেও তারমধ্যে ৪৭টি ভাটায় ইট তৈরির কাজ চলছে। এসব ইটভাটা গুলোতে প্রকাশ্যে বনের কাঠ পোড়ানো হয়। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করায় ইট পোড়ানোর সময় প্রচুর বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। এতে আশপাশের জমিতে ধানের আবাদ ও এলাকার ফলদ গাছপালার উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা হয়েছে, ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইটভাটা মালিক জানান, সরকারি নিয়ম মেনে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পরিবেশবান্ধব ভাটা তৈরি করলে প্রতিযোগিতার এ বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান গুনতে হবে। কাঠ পুড়িয়ে যারা ইট তৈরি করছে, তাদের উৎপাদন খরচ কম থাকায় কম মূল্যে ইট বিক্রি করতে পারে। ফলে তাদের সাথে ঠিকে থাকতে বাধ্য হয়ে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়াতে হচ্ছে। ইটভাটায় আগুন দেয়ার আগে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চুলায় আগুন দিতে হয়, না হলে সমস্যায় পড়তে হয়।

এদিকে ইট ভাটা গুলো অতিরিক্ত কাঠ পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণসহ নানা রকম কৃষি উৎপাদনে বাঁধা সৃষ্টি করছে। কৃষি জমির পাশে বেশিরভাগ ইট ভাটা থাকায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান কৃষি অফিসের এক মাঠকর্মী।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নদীর তীরে গড়ে ওঠা ইটভাঁটা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নদীর মৎস্য সম্পদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যেমন; গ্রীন হাউস প্রভাবের জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইডের অন্যতম উৎস হচ্ছে ইটভাটা। ইট পোড়ানের ফলে প্রতিদিন উৎপন্ন হচ্ছে প্রচুর পরিমান কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস যা বায়ুদূষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। পাশাপাশি ইটভাঁটা থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ নদীর পানিতে মিশে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং পানিকে দূষিত করে যা মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে এবং নির্গত ধূলিকণা এবং রাসায়নিক পদার্থ জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের উৎপাদক শৈবাল ও প্ল্যাংকটন ধ্বংস করে, যা মাছের প্রধান খাদ্য। খাদ্যের অভাবে জলজ বাস্তুতন্ত্রে মাছের সংখ্যা কমে যায়। হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য নিরাপদ ও উপযোগী করতে হালদার পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ইটভাটা আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং ডিগ্রেডেড এয়ারশেড এলাকায় ভাটা স্থাপন করা যাবে না। অথচ ফটিকছড়ি অঞ্চলের প্রায় ভাটা এই আইনের পরিপন্থী।

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে আরোও বলা হয়েছে, ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে বা জরিমানা গুনেই ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে যাচ্ছেন এসব মালিকেরা। পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেও বন্ধ হচ্ছে না ভাটার কার্যক্রম। রাতে তৈরী করা হচ্ছে ভাঙা চিমনি।

ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুর আহমেদ বলেন, ইটভাটায় বনের কাঠ পোড়ানোর খবর পেলে আমরা উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় অভিযান পরিচালনা করে থাকি। কথিত ইটভাটার মালিক প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজের যে কথা বলছে তার কোন ভিত্তি নাই। এগুলো তাদের অপরাধ ঢাকার একটা চেষ্টা মাত্র।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার হাসানুজ্জামান বলেন, ফটিকছড়ির মাটিগুলো খুবই উর্বর। জৈব সারের চেয়েও শক্তিশালী। এই মাঠিগুলো বিক্রি করলে কেজিতে ১০০টাকার অধিক বিক্রি করা যাবে। অথচ ইট ভাটাগুলো মাটি নামক এই সোনাগুলো অবাধে নষ্ট করছে এবং কাঠ পুড়িয়ে কালো ধুঁয়া সৃষ্টি করে ফসল উৎপাদনে বাঁধা সৃষ্টি করছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রিচার্স অফিসার মো. আশরাফ উদ্দিনের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করার পর নতুন চিমন তৈরি করছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান,হেড অফিস থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আসলে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা শীঘ্রই আবারো অভিযান পরিচালনা করবো,অভিযান চলমান থাকবে।

উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি উপজেলায় অবৈধ তিনটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয় পরিবেশ অধিদফতর। একই সঙ্গে দুটি ইটভাটাকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এদিন মেসার্স জনতা ব্রিকস (জেবি), মেসার্স মনির আহমদ (এমএ), মেসার্স মডার্ন ব্রিকস (এমবি) ইত্যাদি চিমনি ও কিলন ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া মেসার্স মনির আহমদ ব্রিকস এবং মেসার্স বক্কর ব্রিকসকে যথাক্রমে ৩ লাখ ও ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

Share on whatsapp
WhatsApp
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on email
Email
Share on telegram
Telegram