মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী গুলোর সাথে সংঘাত দীর্ঘদিনের।বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে তাতমাদো হিসেবে কুখ্যাত দেশটির সরকারি সেনাদের। সম্প্রতি এ সংঘর্ষের আঁচ এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে, বাংলাদেশেও। গেরিলা যুদ্ধে বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক মার খাওয়ার প্রতিশোধ নিতে জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বিদ্রোহীদের অবস্থানে নিয়মিতভাবে হামলা চালাচ্ছে তাতমাদো।
মিয়ানমারের বিমানবাহিনীর বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাতমাদোর সংঘর্ষের সময় ছোড়া গুলি, গোলাও এসে পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়। এরইমধ্যে নোম্যান্সল্যান্ডে এসে পড়া গোলায় মারা গেছেন এক রোহিঙ্গা শরণার্থী, আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ঢাকার পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে একাধিকবার ডেকে কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে কি সংঘাত বাধাতে চায় মিয়ানমার?
উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে সংঘাত বাধাতে চাইছে মিয়ানমার। এজন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইচ্ছে করেই সামরিক সংঘাতে নেমেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশটিতে থাকা বাকি ৬ লাখ রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। এমন আশঙ্কা করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাই মিয়ানমার সীমান্তে চলমান এসব সংঘর্ষের ঘটনাকে ফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া বার্তা বাংলাদেশের
যুদ্ধবিমান থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল ছোড়া এবং সামরিক হেলিকপ্টারের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় গেল সপ্তাহে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে দুই সপ্তাহে তিনবার তলব করা হয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশ সীমান্তে থামেনি মিয়ানমারের অপতৎপরতা। সীমান্তে সবশেষ হতাহতের ঘটনায় ফের ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে। দেয়া হয় কড়া বার্তা।
লড়াইয়ের কেন্দ্রভূমি বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল
নাফ নদী সংলগ্ন টেকনাফ থেকে ভারতের মিজোরাম পর্যন্ত ২৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত। সীমান্তের বাংলাদেশ প্রান্তে রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলা। আর মিয়ানমার প্রান্তে রয়েছে রাখাইন ও চিন রাজ্য। রাঙামাটির বিলাইছড়ির ধুপানিছড়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সীমান্ত। এ স্থানটিকে এজন্য তিন মাথা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। অত্যন্ত দুর্গম এ অঞ্চলে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল থাকায় এখানে সক্রিয় তৎপরতা রয়েছে আরাকান আর্মি, চিন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মিসহ দেশটির অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর।
বেড়েছে লড়াইয়ের তীব্রতা, ব্যবহার হচ্ছে বিমানবাহিনী
২০১৭ সালে নৃশংস জাতিগত গণহত্যার মাধ্যমে রাখাইনের স্থানীয় অধিবাসী রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে মিয়ানমারের কুখ্যাত সামরিক বাহিনী তাতমাদো। এর পর থেকে কিছুটা স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও গত দুই মাস ধরে আবারও লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন ও চিন রাজ্যে। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলছে জোর লড়াই। গত ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মংডুতে আরাকান আর্মির হামলায় মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ সদস্য নিহতের দাবি করা হয়। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
পালেতোয়ায় মুখোমুখি আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনা
রাখাইনের মংডু, বুথিডং, রাথিডং, ম্রাউক-উ এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়ায় চলছে তাতমাদো ও আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই। পালেতোয়া জায়গাটা যদিও চীন প্রদেশে পড়েছে কিন্তু আরাকান আর্মি মনে করে, এটা উত্তর আরাকানেরই অংশ। জায়গাটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কালাদান নদী এ জনপদে যোগাযোগের বড় মাধ্যম। দুর্গম এ এলাকায় তেমন কোনো রাস্তাঘাট নেই। কালাদান নদী ধরে নৌপথই যোগাযোগের মূল মাধ্যম। আগে এ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো চিন ন্যাশনাল আর্মির গেরিলারা। বর্তমান সেখানে তৎপরতা বেড়েছে আরাকান আর্মির।
ভারতের প্রকল্পে বেড়েছে এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
মিয়ানমারের সবচেয়ে গরিব প্রদেশ চিন। তবে ইদানীং এই এলাকার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে ভারতের একটি প্রকল্পের করণে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ সুগম করতে ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশের মধ্যে দিয়ে একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত। তাদের উদ্দেশ্য এ পথে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সরাসরি সংযোগ। মিজোরামের আইজল থেকে চিন প্রদেশের পালেতোয়া হয়ে রাখাইনের সিত্তে পর্যন্ত ‘কালাদান বহুমাত্রিক যোগাযোগ প্রকল্প’ নামে ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারত। তবে ১৪ বছর হয়ে গেলেও কাজটি শেষ করতে পারেনি তারা। এই অঞ্চলে চলমান সংঘাতের পেছনে কালাদান প্রকল্পের ভূমিকাও রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লড়াই থেকে বাঁচতে মিজোরামে আশ্রয় নিচ্ছে উদ্বাস্তুরা
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের যুদ্ধে ৯ হাজার ৬০০ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। ২০২১ সালে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর চিন ও আরাকান থেকে মিজোরামে নতুন করে উদ্বাস্তু ঢুকেছে ৩০ হাজার। এই উদ্বাস্তুরা আবার রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে না। কারণ এ অঞ্চলের প্রধান অধিবাসী খুমি-চিনরা মিজোদের মতোই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।